পিতার অবর্তমানে আরো প্রজ্বলিত
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপের যাত্রা হয় ১৯৫৮ সালে। চার বন্ধু মিলে ২০ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। বর্তমানে ওষুধ শিল্পের পাশাপাশি বস্ত্র খাত, টয়লেট্রিজ পণ্য উৎপাদনসহ নানামুখী ব্যবসা রয়েছে গ্রুপটির। শূন্য থেকে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে আরো বড় হচ্ছে। স্থানীয় বাজারনির্ভর শিল্প থেকে এখন স্কয়ারের বিনিয়োগ রয়েছে দেশের বাইরেও। গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের।
স্কয়ার গ্রুপের মতো গত কয়েক দশকে দেশে গড়ে উঠেছে বড় বেশ কয়েকটি ব্যবসায় গ্রুপ। নিরলস শ্রম ও অব্যাহত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিন্দু থেকে সিন্ধু গড়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। তাদের লড়াইটা ছিল প্রতিষ্ঠার। স্বল্প পুঁজিতে গড়ে ওঠা লাখ টাকা টার্নওভারের প্রথম প্রজন্মের ওই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কয়েক হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করছে। প্রথম প্রজন্মের পর এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব এখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের হাতে।
বণিক বার্তার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মূল প্রতিষ্ঠাতার প্রয়াণের পর পরবর্তী প্রজন্মের হাতে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই আরো বড় হয়েছে। বিশ্লেষকরাও বলছেন, প্রথম প্রজন্মের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজস্ব সক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই ব্যবসার টেকসই সম্প্রসারণ নিশ্চিত করে চলেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার প্রয়াণ-পরবর্তী ব্যবসার ব্যাপ্তি বিবেচনায় এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে বণিক বার্তা।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার প্রয়াণের পর দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতার বিষয়ও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শও গুরুত্ব পেয়েছে এতে। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যবসা বড় হওয়া বাংলাদেশের বৃহৎ কোম্পানির সংখ্যা হাতে গোনা।
স্কয়ার গ্রুপসহ এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে আমজাদ খান চৌধুরীর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, চট্টগ্রামভিত্তিক আবুল খায়েরের আবুল খায়ের গ্রুপ, সেখ আকিজ উদ্দিনের আকিজ গ্রুপ ও সৈয়দ হুমায়ূন কবীরের রেনাটা। এ প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও মূল উদ্যোক্তার প্রয়াণের পর পরবর্তী প্রজন্ম দ্বারা পরিচালিত আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। কভিডকালে দেশের বেশকিছু বৃহৎ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা প্রয়াত হয়েছেন। তাদের গড়ে দেয়া প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছে পরবর্তী প্রজন্ম। তবে বণিক বার্তার বিশ্লেষণে কভিড-পূর্ব সময় বিবেচনায় নেয়ায় সেসব প্রতিষ্ঠানকে এর বাইরে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধাররা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্মের ব্যবসা আছে, যেগুলো ভালো চলছে। এর প্রধান কারণ হলো সুশৃঙ্খল কাঠামোভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম। একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবসা হচ্ছে না। এ ধরনের পরিস্থিতি থাকলে ব্যবসাটাকে এগিয়ে নেয়া আরো সহজ হয়। মালিকপক্ষের স্পষ্ট ধারণা থাকে তাদের পারিশ্রমিক কত হওয়া উচিত। ব্যবসা থেকে পুঁজি উত্তোলন করতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও ধারণা থাকতে হয় মালিকপক্ষের।
পারিবারিক ব্যবসা এখন ইউরোপের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ করপোরেট সংস্কৃতির চর্চায় আরো পরিপক্বতা আনতে হবে। এতে পারিবারিক ব্যবসার কোম্পানিগুলো বিস্তৃতি বাড়বে। এছাড়া পরবর্তী প্রজন্মকে প্রশিক্ষিত করা হলে ব্যবসা আরো টেকসই হয়ে উঠবে।
পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে স্যামসন এইচ চৌধুরীর উদ্যোগে যাত্রা করা ছোট উদ্যোগ আজ বিরাট প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। ওষুধ, বস্ত্র খাত, টয়লেট্রিজ পণ্য উৎপাদন, গণমাধ্যমসহ স্কয়ারের বিনিয়োগের গণ্ডি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় ওষুধ উৎপাদনকারী কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে স্কয়ার। ২০১২ সালে প্রয়াণ হয় স্যামসন এইচ চৌধুরীর। এরপর গত প্রায় এক দশকে স্কয়ার গ্রুপের ব্যবসার আকার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বর্তমানে স্কয়ার গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। দ্বিতীয় প্রজন্মের এ দক্ষতা প্রদর্শনের পর প্রতিষ্ঠানটিতে এখন যুক্ত হয়েছে তৃতীয় প্রজন্ম।
স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার তপন চৌধুরী বলেন, এখন ব্যবসাগুলো কিন্তু চালান সব প্রফেশনালস বা পেশাদাররা, তারা কিন্তু কোনো অংশেই মালিক থেকে কম নন। পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েই চালান। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানই পেশাদারদের দিয়ে পরিচালিত। আক্ষরিক অর্থে হয়তো তারা কোম্পানির মালিক নন, কিন্তু দায়িত্ববোধ ও ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা অনেকাংশেই মালিকদের চেয়েও বেশি।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ব্যবসা টিকিয়ে রেখে এগিয়ে নেয়ার কৌশল প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বলেন, প্রথমত, উত্তরসূরিদের প্রস্তুতি প্রয়োজন। আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, ব্যবসার দায়িত্ব নেয়ার জন্য উত্তরসূরিরা নিজেরা কতটা প্রস্তুত হয়েছে। লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ ও পূর্বসূরিদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের এ প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্গানাইজেশনাল কালচার বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বুঝতে হবে। অনেকের সন্তান এসে প্রথমেই সরাসরি ম্যানেজমেন্টে বসছে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় ব্যবসা পরিচালনার খুঁটিনাটি শিখতে হবে একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে। এতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিভিন্ন দিক বুঝতে সুবিধা হবে।
টিউবওয়েল তৈরি ও বিপণনের মাধ্যমে যাত্রা এখনকার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে আমজাদ খান চৌধুরী অবসর নেন। ১৯৮১ সালে রংপুরে শুরু করেন ফাউন্ড্রি বা টিউবওয়েল তৈরি ও আবাসন ব্যবসা। পুঁজি বলতে পেনশনের টাকা। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা পায় এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড প্রাণ। স্থানীয় বাজারে দেশের প্রায় সব জেলায় আছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পদচারণা। পরবর্তী সময়ে তা দেশের সীমানাও ছাড়িয়েছে। ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে আনারস রফতানি দিয়ে শুরু করে এখন প্রাণের পণ্য বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে রফতানি হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খান চৌধুরীর প্রয়াণ হয় ২০১৫ সালে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রুপের বার্ষিক আয় ছিল ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রথম প্রজন্মের প্রয়াণের পর প্রাণ-আরএফএলের নতুন বিনিয়োগের খাতগুলোর মধ্যে আছে ফুটওয়্যার, রাসায়নিক, সুরক্ষা পণ্য ও টয়লেট্রিজ। আমজাদ খানের প্রয়াণের সময় কোম্পানিটির কর্মী ছিল ৭৫ হাজার। পাঁচ বছর অতিক্রমের পর বর্তমানে কর্মসংস্থান ১ লাখ ১৫ হাজার হওয়ার পথে আছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, আজ থেকে ২৯ বছর আগে আমি যখন ব্যবসায় যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের যে পরিধি ছিল তার থেকে এখন অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যবসার একটি পরিপক্বতার সময় থাকে। আগামী প্রজন্ম যারা দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসাকে এগিয়ে নেবে, অনেক সময় তাদের যোগ্যতার ওপর ব্যবসার ভালো-মন্দ নির্ভর করে। আমি মনে করি, ভাগ্যের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। মানুষ ভালো হলো, চেষ্টা ভালো হলো, তার পরও কপাল যদি প্রতিকূলে থাকে তাহলে ভালো কিছু করাটা জটিল হয়ে যায়। আমরা অনেক ছোট পরিধিতে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ওই পরিধি থেকে আমরা ব্যবসা অনেক গুণ বাড়িয়েছি। এখন আমার পরবর্তী প্রজন্মও ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের সময় ব্যবসার গতি আরো বাড়বে। বাড়াটাই স্বাভাবিক। তাদের যেভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও মূল্যবোধ যদি ঠিক থাকে তাহলে তারা ব্যবসায় আরো এগিয়ে যাবে।
পিতার প্রয়াণের পর ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান খান চৌধুরী বলেন, আমার বাবার অনেক গুণের মধ্যে একটি ছিল তিনি অর্গানাইজেশন খুব ভালো বুঝতেন। তিনি ব্যক্তি পরিচালিত ব্যবসা থেকে করপোরেট পরিচালিত ব্যবসায় বেশি নজর দিতেন। আমাদের ব্যবসাটা কখনই একজন খেলোয়াড়কেন্দ্রিক ব্যবসা আকারে গড়ে ওঠেনি। তিনি সামরিক বাহিনীর মানুষ ছিলেন। সামরিক বাহিনীতে একজন মানুষ যুদ্ধ জয় করতে পারে না। সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ জয় করতে হয়। তাই বাবার কাছ থেকে আমরা টিমওয়ার্ক বা দলগতভাবে কাজ করাটা রপ্ত করতে পেরেছি। তিনি আমাদের এত ভালো একটা দলের সদস্য করেছেন যে তার প্রয়াণের পর আমি শুধু বাবার শূন্যতা অনুভব করেছি, ব্যবসায়ী বাবার শূন্যতা তেমনভাবে অনুভব করিনি। স্বভাবতই বাংলাদেশে পরিচয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি। এ পরিবেশে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, সংযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আমি আমার বাবার পরিচয়ের কারণে রক্ষা পাই। বাবার সেই ছত্রচ্ছায়া সবসময়ই ছিল।
দেশের আরেক বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপের যাত্রা হয় ১৯৫৩ সালে। প্রতিষ্ঠাতা আবুল খায়েরের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ছিল বিড়ি ও ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার প্রয়াণের পর বিড়ির ব্যবসা থেকে সরেনি দ্বিতীয় প্রজন্ম। তাদের হাত ধরে স্টিল, সিরামিকস, ডেইরি প্রডাক্টসহ চা বাগান, খাদ্যদ্রব্য, সিমেন্ট ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন করে বহু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের আবুল খায়ের গ্রুপ। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থান ছাড়িয়েছে ৪৫ হাজার।
আবুল খায়ের গ্রুপের প্রথম প্রজন্মের মূল উদ্যোক্তা আবুল খায়েরের মৃত্যু হয় ১৯৭৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। তার তৈরি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী সময়ে ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্ম। তাদের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠানটি সুশাসন চর্চা শুরু করে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাজ করেন প্রতিষ্ঠানটিতে। দেশী-বিদেশী দক্ষ নির্বাহীদের নিয়োগ দিয়ে গড়ে তুলেছে করপোরেট সংস্কৃতি। এসব অর্জনে শুরু থেকে প্রভাবক হিসেবে রয়েছেন প্রয়াত আবুল খায়েরের বড় সন্তান ও গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। দেশের বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে তৃতীয় প্রজন্ম।
দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে স্টিল, সিরামিকস, ডেইরি প্রডাক্টসহ চা বাগান, খাদ্যদ্রব্য, সিমেন্ট ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। উত্তরসূরিরা গড়ে তুলেছেন মাঝারি ও ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নব্বইয়ের দশকে স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্কের মতো ব্র্যান্ডের পাশাপাশি গরু মার্কা ঢেউটিন দিয়ে ইস্পাত শিল্পে নাম লেখায়। একই দশকে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির খাদ্য ব্র্যান্ডের মধ্যে আছে স্টারশিপ ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার। ১৯৯৭ সালে আসে মার্কস ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার। আর সিলন চা নিয়ে বাজারে আসে ২০০৪ সালে। রড উৎপাদনে বড় ধরনের বিনিয়োগের পাশাপাশি সিমেন্ট খাতেরও বেশির ভাগ চাহিদা পূরণে সক্ষমতা তৈরি করেছে আবুল খায়েরের শাহ সিমেন্ট।
১৯৪০ সালের শেষ দিকে পাট বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন সেখ আকিজ উদ্দিন। ৭৩ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করলেও আকিজ গ্রুপের শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ নব্বইয়ের দশকে। গ্রুপটির ব্যবসার খাতগুলোর মধ্যে আছে নির্মাণসামগ্রী, দুগ্ধ খামার, পানীয়, কাগজ ও সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন। নির্মাণ উপকরণ খাতে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আকিজ গ্রুপের নাম উল্লেখযোগ্য।
সত্তরের দশকে মোটরচালিত কারখানা শুরু করেন সেখ আকিজ। ওই সময়ই প্রিন্টিং-প্যাকেজিং কারখানা গড়ে তোলা হয়। সেটা ছিল বড় ধরনের রূপান্তর। নব্বইয়ের দশকে বস্ত্র খাতে আসে আকিজ গ্রুপ। এ সময় আরো অনেক নতুন ব্যবসার খাতগুলোর মধ্যে ছিল সিমেন্ট, পার্টিকেল বোর্ড মিল এ রকম কিছু ব্যবসা। এরপর ১৯৯৭ সালে আকিজ গ্রুপের জুট মিলেরও যাত্রা হয়। ২০০০ সালের পর এ ব্যবসাগুলো সম্প্রসারণের পাশাপাশি আরো কিছু ব্যবসা শুরু করে আকিজ গ্রুপ। ২০১০ সালে সিরামিকের ব্যবসা শুরু হয়। গ্রুপের মোট কর্মসংস্থান ৭০ হাজারের বেশি। টার্নওভার ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, আকিজ একটি ক্রমবিকাশমান প্রতিষ্ঠান। ব্যবসার শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানটি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আমার বাবা বালক বয়সে খুবই স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সেদিন থেকে শুরু করে আজ যে অবস্থানে আছি, পুরো সময়টিতে আমরা রূপান্তরিত হয়েছি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের জন্য এ ব্যবসাকে বৈচিত্র্যময় করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে আমার বাবাই এ প্রতিষ্ঠানকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করেছেন। তখন তিনি একা ছিলেন। এখন আমরা পাঁচ ভাই এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় আছি। পাঁচ ভাইয়ের বৈচিত্র্যময় ব্যবসায়িক আগ্রহ নিয়ে আজ আমরা ব্যবসা করে চলেছি।
আশির দশকের শেষ দিকে সাজেদ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। ১৯৮৭ সালে ছোট এক গ্যারেজে যাত্রা করা সাজেদা ফাউন্ডেশন কালের পরিক্রমায় বড় হয়েছে। কলেবর বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে কাজের পরিধিও। সংস্থাটি বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা ও নানা সামাজিক কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণসেবা কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছড়িয়েছে দেশের ২৫ জেলায়। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। দেশের ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষ বিক্রেতা লাভজনক প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেডেরও সিংহভাগ মালিকানা সাজেদা ফাউন্ডেশনের।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে উৎপাদনের চেয়ে গবেষণার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট ফাইজার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় কোম্পানিটি। ১৯৯৩ সালে ফাইজারের বাংলাদেশে ব্যবসার মালিকানা স্থানীয় শেয়ারহোল্ডারদের হাতে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায়ই রেনাটা প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। ১৯৯৫ সালেই তিনি অবসর নেন। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকলেও নির্বাহী দায়িত্বগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি।
২০১৫ সালে সৈয়দ হুমায়ুন কবীর প্রয়াত হন। তার সন্তান সৈয়দ এস কায়সার কবীর বর্তমানে রেনাটার সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাবার প্রয়াণে আমরা ভীষণ শোকাহত ছিলাম। তবে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা শক্তভাবে দাঁড়াতে পেরেছিলাম; কারণ বাবা ক্ষমতা আঁকড়ে নয়, ভাগ করে নেয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমানে রেনাটা জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকদের দিয়ে স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব বজায় রেখে পরিচালিত হয়। আমার হস্তক্ষেপ খুব কমই। ফলে প্রতিষ্ঠানটি অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবস্থাপকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যারা প্রত্যেকে রেনাটার প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সচেতন।
রেনাটা লিমিটেড এখনো সফলভাবেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটির ওষুধ রফতানি হচ্ছে। আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা ও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি করছে কোম্পানিটি। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি, পরের বছর ২ হাজার ১৩৩ কোটি, ২০১৮-১৯ সালে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ও ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে কোম্পানিটি।
সৈয়দ এস কায়সার কবীর বলেন, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসায় আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ওই সময় রেনাটা মারাত্মক আর্থিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল দক্ষ নেতৃত্বের। ফাইজারে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ড. সরোয়ার আলীর হাতে তখন রেনাটার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি যখন রেনাটার ব্যবসা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত আমি তখন কোম্পানির ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করছি। নির্বাহী দায়িত্বে না থাকলেও বাবার প্রভাব ছিল কোম্পানিতে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পর্যায়ক্রমে বাবার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আমার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বেশির ভাগ পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা তৃতীয় প্রজন্মের বেশি টিকে থাকে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক ব্যবসা টেকসই করার ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় নির্ভর করছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা মালিকের মৃত্যু, ব্যবসায় উত্তরাধিকারদের একটা অংশের অনাগ্রহ ও পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতা। বৈশ্বিক ও স্থানীয় দুই প্রেক্ষাপটেই পারিবারিক ব্যবসার চ্যালেঞ্জের মধ্যে নেতৃত্ব, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক সম্পর্ক, পেশাজীবীদের ভূমিকার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যবসাকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হলে পরিবার ও পেশাদার কর্মী দুইয়ের সমন্বয় থাকতে হবে। আর ব্যবসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এগিয়ে নিতে অবশ্যই উত্তরসূরিদের চিন্তাভাবনা শেয়ারহোল্ডার থেকে স্টেকহোল্ডার পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।
পারিবারিক ব্যবসার বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি জরিপ চালায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক পেশাজীবী সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউজকুপার্স (পিডব্লিউসি)। সেই জরিপ অনুযায়ী, দেশে পারিবারিক ব্যবসাগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ সঠিক দক্ষতা ও সক্ষমতার জোগান নিশ্চিত করা। পারিবারিক ব্যবসাগুলোর বিকাশ হয়েছে মূলত প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের দ্বারা।
আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসির ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, তারাই ভালো করছে, যারা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও মালিকপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে একটি সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে। এমন সেতুবন্ধের কারণেই স্কয়ার, আবুল খায়ের, প্রাণ-আরএফএল, আকিজ ও রেনাটা প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছে। প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত কাজে লাগিয়ে ও বর্তমান নেতৃত্বের দক্ষতায় প্রতিষ্ঠানগুলো বড় হচ্ছে।